বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া

থ্যালাসেমিয়া |

ok

বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ, যা মাতা-পিতার কাছ থেকে সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে এই রোগ কিছুটা প্রতিরোধ করা যায়।
থ্যালাসেমিয়া হলো রক্তস্বল্পতার রোগ। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষমতা কমে যায়। কোনো মা ও বাবার রক্তে যদি থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকে এবং সেখান থেকে বংশপরম্পরায় যদি তা সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তখন ওই জিনের কারণে সন্তানের রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে থ্যালাসেমিয়া হতে পারে। কেননা বাবা থেকে একটা জিন এবং মা থেকে আরেকটা জিন—এই দুই জিন দিয়ে শিশুর জন্ম হয়। তবে মা ও বাবার যেকোনো একজন থেকে একটি ডিফেক্টিভ জিন যদি শিশুর মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তবে তেমন সমস্যা হয় না। এর মানে হলো, আরেকটি জিন ভালো আছে বা সক্রিয় আছে। তখন ওই সক্রিয় জিনের মাধ্যমে যতটুকু হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে, সেটা দিয়ে মোটামুটি সে চলতে পারে। আরলি স্টেজ, মিডল স্টেজ পর্যন্ত তার কোনো সমস্যা হয় না। তবে মিডল স্টেজ পার হওয়ার পর অনেকের (সবার নয়) দেখা যায়, ওই একটা জিন দিয়ে যতটুকু রক্ত উৎপাদন করতে পারছে, তা যথেষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি কিছু রক্তস্বল্পতা বা থ্যালাসেমিয়ায় ভুগতে পারে।

আমরা জানি, হিমোগ্লোবিনের কারণেই রক্তের রং লাল হয়। এই হিমোগ্লোবিনের দুটি অংশ থাকে। একটি হলো হিম, আরেকটি হলো গ্লোবিন। এই গ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে পলি চেন থাকে। দুটি আলফা চেন ও দুটি বিটা চেন—অর্থাৎ এই দুই জোড়া চেনের সমন্বয়ে গঠিত হয় গ্লোবিন এবং এর সঙ্গে হিম মিলে হয় হিমোগ্লোবিন।
থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। যাদের থ্যালাসেমিয়া আছে, তাদের এই আলফা চেন ও বিটা চেন হয় একেবারেই তৈরি হয় না অথবা পরিমাণে কম তৈরি হয়। ফলে তার হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয়ে যায় এবং যেটুকু তৈরি হয় তা-ও ত্রুটিযুক্ত, যথেষ্ট নয়।

কারণ
থ্যালাসেমিয়ার জন্য বিশেষ কোনো কারণ দায়ী নয়। এটা বংশগত বা জন্মগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। একটি শিশুর দৈহিক গঠন থেকে শুরু করে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি—সব কিছুই জেনেটিক্যালি কন্ট্রোল্ড অর্থাৎ বংশগত বা মা-বাবার গঠন থেকেই হয়। ঠিক তেমনি অনাগত শিশুটির শরীরের রক্ত কেমন হবে, তা-ও নির্ভর করে মা-বাবার রক্তের গঠন কেমন ছিল তার ওপর।

ধরন
থ্যালাসেমিয়া মেজর ও থ্যালাসেমিয়া মাইনর হলো থ্যালাসেমিয়ার ধরন। সমস্যাটা যদি একজন শুধু বাবা অথবা শুধু মায়ের মধ্য থেকে আসে, তাহলে তা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। আর যদি দুজনের দেহ থেকেই আসে, তাহলে তা থ্যালাসেমিয়া মেজর। বেশ সিরিয়াস আকার ধারণ করতে পারে থ্যালাসেমিয়া মেজর থাকলে।
মা ও বাবা উভয়ের ক্ষেত্রে যদি জেনেটিক ডিফেক্ট থাকে বা উভয়ের কাছ থেকে যদি এই থ্যালাসেমিয়ার জিন সঞ্চারিত হয়, অর্থাৎ বংশপরম্পরায় যদি সেটাকে ধারণ করে নিয়ে আসা হয়, তখন দেখা যাবে হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষমতাটা একেবারে সংকুচিত হয়ে আসছে।

উপসর্গ
কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না তার কিছু উপসর্গ জন্মের পরপরই শিশুটির মধ্যে দেখা দেয়। তবে যারা দুই জিন থেকেই সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বা যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর, তাদের লক্ষণগুলো বেশি দেখা দেয়। যেমন—
♦ ধীরে ধীরে শরীর গঠন হয়।
♦ বেশ রোগা ও দুর্বল দেখায়। চেহারার মধ্যে ফ্যাকাসে ভাব আসে।
♦ হাঁটা, হামাগুড়ি, বসা, খেলা ইত্যাদির গতি ধীর হয়।
♦ ক্ষুধামান্দ্য থাকে।
♦ কাজের স্পৃহা থাকে না।
♦ ব্রেন ঠিকমতো কাজ করে না।
♦ দুই চোখের মাঝখানের অবস্থানগত দূরত্ব বেড়ে যায়।
♦ দুই চোখের মাঝখানে নাকের সংযোগস্থল প্রশস্ত হয়ে যায়।
♦ চিবুকের দুই পাশ একটু ফোলা ফোলা মনে হতে পারে।
♦ দাঁত কিছুটা ফাঁকা হয়ে থাকে, বন্ধ হয় না।
♦ ললাটের হাড় সামনের দিকে ফুলে যায়।
♦ চোখ অনেকটা হলুদাভ হয়।
♦ পেট অপেক্ষাকৃত বেশি ফুলে যায়।
♦ পরীক্ষায় দেখা যাবে—প্লীহা, যকৃৎ আকারে বড় ইত্যাদি।

জটিলতা
থ্যালাসেমিয়ার সঠিক চিকিৎসা না করালে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন—তখন তার দেহে এনার্জির ঘাটতি হবে। পালপিটিশন হতে পারে। তখন রোগী অল্পতেই হাঁপিয়ে যাবে এবং একসময় হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। এ ছাড়া লিভার বড় হয়ে যেতে পারে। শরীরের নিম্নাংশে পানি জমে যাওয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি।
ক্রনিক অ্যানিমিয়া যদি বাড়তে থাকে এবং এর যদি কোনো প্রতিকার করা না হয়, তাহলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভবিষ্যতে তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পেতে একসময় অকেজো হয়ে যেতে পারে। এভাবে পুরো শরীর অকেজো হয়ে একসময় জীবন বিপন্ন হতে পারে।

চিকিৎসা
মাইনর থ্যালাসেমিয়ার তেমন চিকিৎসার দরকার হয় না। তবে মেজর থ্যালাসেমিয়ায় নিয়মিত রক্তসঞ্চালন প্রধান চিকিৎসা, যাতে ভালো থাকা যায়। তবে রোগটি যেহেতু জন্মগত সমস্যা থেকে, তাই বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করলে থ্যালাসেমিয়া পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ম্যাচ ডোনার লাগে। ইদানীং অবশ্য দেশেই বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন হচ্ছে।
আর যারা বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে পারছে না বা যাদের থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া বা মাইনর, তাদের নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে জীবন সচল রাখার চেষ্টা করতে হবে।
তবে বারবার রক্ত দিতে গিয়ে কিন্তু কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেমন—শরীরে আয়রন জমে গিয়ে হার্ট, লিভার, ব্রেনে সমস্যা, হরমোনগুলো নষ্ট হয়ে ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যা হতে পারে। তখন রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসাও চালিয়ে যেতে হবে।

প্রতিরোধে করণীয়
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন থাকতে হবে। যেমন—
♦ রক্ত তৈরির জন্য যে উপাদান, সেই পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
♦ শিশু যেন ঠিকমতো পুষ্টি পায়, এ জন্য তাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। একই খাবার বারবার না দিয়ে বয়স অনুযায়ী সব খাবারের কম্বিনেশন থাকতে হবে।
♦ শিশু যেন কৃমিতে আক্রান্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
♦ রোগীর রক্তস্বল্পতা হলে ডাক্তারকে দেখাতে হবে।
♦ থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে। অর্থাৎ একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে অন্য কোনো বাহককে বিয়ে না করা উচিত।
♦ স্বামী ও স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক হলে, পরিবারে একাধিক থ্যালাসেমিয়ার শিশু থাকলে, পরবর্তী সময় সন্তান নিতে হলে পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ ভ্রূণ থ্যালাসেমিয়া হলে তা পরিহার (গর্ভপাত) করাতে পারেন। গর্ভাবস্থায় এই পরীক্ষাটি আট থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে করাতে পারলে ভালো।
♦ পুষ্টির অভাব ও কৃমির কারণেও রক্ত কমে যেতে পারে—এ জন্য প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে থ্যালাসেমিয়া কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যাবে।

বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ
জন্মগত থ্যালাসেমিয়ার কারণগুলো জানতে হবে। এ জন্য বিয়ের আগে প্রত্যেক হবু স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই উচিত রক্ত পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া যে থ্যালাসেমিয়ার জিন তাদের কারোর মধ্যে রয়েছে কি না। এই পরীক্ষায় একজনের থ্যালাসেমিয়া থাকলে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু দুজনের থাকলে সে ক্ষেত্রে বিয়ে করা উচিত নয়। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে সন্তান নেওয়ার আগেও রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।